September 26, 2023, 9:50 pm
রাসেল কবির মুরাদ . কলাপাড়া(পটুয়াখালী)প্রতিনিধি : কলাপাড়ার বিস্তীর্ণ নোনা ভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে হাজারো গোল বাগান। সারা বছরজুড়ে গুড়ের তৈরি বিভিন্ন প্রকার পায়েস কিংবা মুখরোচক খাবার পছন্দ করেন না এমন মানুষ কমই আছে। প্রকৃতির সৃষ্টি এ গোল বাগান থেকে আহরিত রস কিংবা গুড়ে সুগার কম থাকায় দিনে দিনে ক্রেতাদের কাছে এর কদর বেড়েছে কয়েকগুন। উপকূলীয় কলাপাড়ায় বিস্তির্ন এলাকায় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল থাকায় প্রাকৃতিকভাবে জন্মনিচ্ছে গোলগাছ। কিন্তু চাহিদা বাড়লেও ক্রমশই ধ্বংস করা হচ্ছে বাগান। ফলে বাগানের পাশাপাশি কমছে গাছিদের সংখ্যাও। গোল বাগান বিনষ্টের ফলে গুড় উৎপাদন কমে যাওয়ায় এখন অনেক গাছিরাও করেছেন পেশার পরিবর্তন। ফলে রাষ্ট্রীয় ভাবে বাগান রক্ষা ও নদীর তীর কিংবা নোনা জলাশায়ে গোল বনায়নের দাবী গোলচাষী এবং গাছিদের।
শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এ গোলবাগান থেকে বছরের ৬ মাস সময় ধরে তিন দশক যাবৎ রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরীর মাধ্যমে জীবন-জীবিকা চলছে প্রায় হাজারো পরিবারের। শীতের শুরুতেই বিকালে গাছের ডগা কেটে হাড়ি পাতেন গাছিরা। রাতভর হাড়িতে জমা রস কাকডাকা ভোরে সংগ্রহ করেন তারা। এরপর চাতালে জাল দিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে তৈরী করা হয় গুড়। আর এসব গুড় গাছিরা বিক্রি করছেন ১৭০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে। বিশেষ করে রোগাক্রান্ত মানুষের কাছে লবনাক্ত এই গুড়ের চাহিদা অনেক।
কলাপাড়া পৌর শহরের ২নং ওয়ার্ডের মো. নিজাম উদ্দিন জানায়, ডায়াবেটিসের জন্য সব ধরনের মিষ্টি খাওয়া নিষিদ্ধ করেছেন চিকিৎসক। তবে লবনাক্ত গোলগুড়ে সুগার কম থাকায় অমি মাঝে মধ্যেই গোলের গুড় সীমিত খেতে পারি। আমার তাতে সমস্যা হয়না। এদিকে এই গুড়ের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাগান কমে যাওয়ায় কাঙ্খিত রস সংগ্রহ করতে পারছেন না গাছিরা। এছাড়া বাগান ধ্বংসের ফলে রোজগার কমে যাওয়ায় পেশার পরিবর্তন করছেন অনেকে। গুড়ের উৎপাদন কমে যাওয়ায় গোলগাছ সংরক্ষনের দাবি কৃষি বিভাগেরও।
নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামের গোলগাছি রাজন কুমার (৫৫) বলেন, কলাপাড়ার নীলগঞ্জ, তেগাছিয়া, নবীপুর গ্রামের ২৫ জন কৃষক এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত। ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীরা বাড়িতে গিয়ে অগ্রিম টাকা দিয়ে আসেন গুড়ের জন্য। কিন্তু ক্রমাগত বাগান ধংসের ফলে এখন ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে পারছেন না। তার দাবি বেড়িবাঁধের বাহিরে সরকারি খাস জমিতে গোল গাছ লাগিয়ে আমাদের দ্বায়িত্ব দিলে রক্ষনাবেক্ষনসহ এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে পারতাম। একই গ্রামের ৭০ বছর বয়সী অঞ্জনা বিশ্বাস জানায়, ৫০ বছর ধরে এ কাজ করছি শুরুতে প্রতি ১০ থেকে ১৫ কলস রস পেতাম। এখন ৮ কলস পাই মাঝখানে বন্যার কারণে বাহড়ে ছড়া কম হতো এখন আবার হচ্ছে।
নবীপুর গ্রামের আরেক গাছি যাদব চন্দ্র মন্ডল (৬৫) জানায়, তার পূর্ব পুরুষ থেকে প্রায় ১০০ বছর ধরে এই পেশায় নির্ভরশীল হয়ে জীবীকা নির্বাহ করে আসছেন। এ গাছির স্ত্রী সিমা মন্ডল (৫০) বলেন, স্বামীর সাথে দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে গুড় তৈরিতে কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে যোগান দিয়ে আসছেন। কিন্তু বর্তমানে গোল গাছের সঙ্কটে তাদের পেশা প্রায় পরিবর্তনের দিকে ঝুঁকছে। আগে আমার ছেলে মেয়ে ও পুত্রবধুও এই কাজে সংশ্লিষ্ট ছিলো। তারা এখন পেশার পরিবর্তন করে ভিন্ন পেশায় যোগ দিয়েছেন। তাই গাছিরা বলছেন, প্রকৃতি রক্ষা এবং ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে বনায়নের পাশাপাশি গোলগাছ সংরক্ষনের কোন বিকল্প নেই। এদিকে খুব দ্রুতই সরকারের উদ্যোগ নেয়া উচিৎ।
কলাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এম আর সাইফুল্লাহ জানান, গোলগাছ মানুষের ঘরনির্মানসহ প্রকৃতি রক্ষায় একটি বড় ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও গুড় থেকে বিশাল একটা অর্থ আয়ের পাশাপাশি হাজারো মানুষ এর উপর নিভর্রশীল হয়ে জীবীকা নির্বাহ করে। এমনকি ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষ সহনশীল পরিমানে গোলের গুড় খেতে পারে। গোলবাগান রক্ষায় আমরা উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের সাথে কথা বলেছি। শীঘ্রই গোল বাগান রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে বলে তিনি আশ্বস্ত করেন।
পটুয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ-আল মামুন বলেন, গোলবন সংরক্ষনসহ বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় আন্ধারমানিক নদীর তীরসহ নোনা জলভূমিতে গোলচারা রোপন করা হবে।